Home বাংলাদেশ রাজনীতি ভারত ও পাকিস্তানপন্থী রাজনীতির ঠাঁই হবে না বাংলাদেশে: নাহিদ

ভারত ও পাকিস্তানপন্থী রাজনীতির ঠাঁই হবে না বাংলাদেশে: নাহিদ

Posted by on in বাংলাদেশ 0
1st Image

বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ঐতিহাসিক পটভূমির প্রেক্ষাপটে সদ্য আত্মপ্রকাশ করেছে নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অগ্রগামী নেতাদের হাত ধরে গড়ে ওঠা এই দলটি দেশের সামনে এক নতুন স্বপ্নের দুয়ার খুলতে চায়—আদর্শগতভাবে তারা বলছে, দেশের জন্য জরুরি এখন একটি ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠা। গত দেড় দশকের ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান ঘটানো জুলাই ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান যেমন বহু সংগ্রামের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ, তেমনি সেখানে নিহিত আছে নতুন রাষ্ট্র বিনির্মাণের ভাবনা। রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে আয়োজিত এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম দলটির লক্ষ্য, আদর্শ ও ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরেন।

বাংলাদেশের জন্ম কেবলমাত্র একটি সার্বভৌম ভূখণ্ড প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শেষ হয়নি; বরং তা ছিল একটি গণতান্ত্রিক, সাম্যভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের সুদীর্ঘ লড়াইয়ের ফল। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ ভাগের পর পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র গড়ে উঠলেও এ অঞ্চলের মানুষের শোষণ-নির্যাতন বন্ধ হয়নি। তাই প্রায় ২৩ বছরের অব্যাহত সংগ্রাম culminate করে ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে, যেখানে লাখো শহীদের রক্তে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এরপরও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ থেমে থাকেনি। ১৯৯০ সালে সামরিক শাসনের পতন ঘটাতে গিয়ে ছাত্র-জনতার বুকের তাজা রক্ত ঝরেছে। তবু স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরোনোর পরও বাংলাদেশে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক ও ন্যায়ভিত্তিক শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি।

গত ১৫ বছর ধরে দেশে যে ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা বলবৎ ছিল, সেখানে বিরোধী মত দমন, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও দুর্নীতি এক রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছিল। জুলাই ২০২৪-এ ছাত্র ও জনতার ব্যাপক অভ্যুত্থান সেই ফ্যাসিবাদী শাসনের পতন ঘটায়। তবে এই অভ্যুত্থান শুধুই এক সরকারের পরিবর্তে আরেক সরকারকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য ছিল না; বরং যে রাষ্ট্রব্যবস্থা জনগণের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছিল, তাকে সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত করে নতুন কাঠামো গঠনের আকাঙ্ক্ষা থেকেই মানুষ রাস্তায় নেমেছিল। এই প্রেক্ষাপটেই জাতীয় নাগরিক পার্টির জন্ম। দলটি মনে করে, বিদ্যমান ব্যবস্থার দোষত্রুটি সংস্কারের সুযোগ সীমিত; তাই সম্পূর্ণ নতুন একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত, অর্থাৎ সেকেন্ড রিপাবলিক, প্রতিষ্ঠাই এখন সময়ের দাবি। জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম স্পষ্ট উচ্চারণে বলেছেন, বাংলাদেশে ভারতপন্থী বা পাকিস্তানপন্থী রাজনীতির কোনো স্থান হবে না। এ অঞ্চলের মানুষ যুগের পর যুগ ধরে পরাধীনতার বিরুদ্ধে লড়াই করে এসেছে। তাই পরাশক্তির ছায়াতলে বা পরনির্ভরশীলতায় নয়, বরং স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বাধীনভাবে বাংলাদেশকে গড়ে তোলাই এ দলের অন্যতম অঙ্গীকার। তাঁর ভাষায়, “আমরা বাংলাদেশের স্বার্থকে সর্বাগ্রে রেখে, বাংলাদেশের জনগণের কল্যাণকে কেন্দ্রে রেখে রাষ্ট্রকে বিনির্মাণ করতে চাই।” এই অবস্থান কার্যত দলটির জাতীয়তাবাদী এবং সার্বভৌমত্বরক্ষায় অনড় মনোভাবেরই প্রতিফলন।

এনসিপির মতে, বিদ্যমান সংবিধানের ফাঁক-ফোকর দিয়ে আবারও স্বৈরতান্ত্রিক বা ফ্যাসিবাদী শাসন ফিরে আসতে পারে। তাই গণতান্ত্রিক উপায়েগণপরিষদ নির্বাচন করে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়নই সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার প্রথম শর্ত। নতুন সংবিধান হবে এমন একটি দলিল, যেখানে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার, রাষ্ট্রের চেহারা ও কাঠামো, প্রশাসনিক পদ্ধতি এবং আর্থসামাজিক নীতিমালাকে গণতান্ত্রিক উপায়ে সুরক্ষিত করা হবে। অতীতের ধারাবাহিক স্বৈরশাসন ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির ইতি ঘটিয়ে জনমানুষের অধিকারকেই কেন্দ্রে রেখে নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলাই এনসিপির মুখ্য লক্ষ্য।

জাতীয় নাগরিক পার্টি নিজেদের একটি গণতান্ত্রিক, সমতাভিত্তিক ও জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দল হিসেবে উপস্থাপন করছে। তারা বিশ্বাস করে, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও পরিবারতান্ত্রিক আধিপত্য দূর করার জন্য দরকার এক নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি। এখানে প্রতিটি পদে মেধা ও যোগ্যতার মূল্যায়ন নিশ্চিত করা হবে, ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত না রেখে জনগণের বিভিন্ন স্তরের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে তাদের মতামতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে। নাহিদ ইসলামের কথায়, “আজকের মঞ্চ থেকে আমাদের শপথ—বাংলাদেশকে বিভক্ত করা যাবে না।” অর্থাৎ বিভেদ ও হানাহানি পেছনে ফেলে ঐক্য, ন্যায়বিচার ও নাগরিক অধিকারের ভিত্তিতে সামাজিক বন্ধন গড়ে তোলাই হবে এনসিপির অন্যতম অগ্রাধিকার।  বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ এখনও সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে আছে। এনসিপি প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে যে, সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা করতে হলে এই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় সম্পৃক্ত করতে হবে। জাতিগত, ধর্মীয়, লিঙ্গীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে রক্ষা করে সবার জন্য সমান সুযোগ ও মর্যাদা নিশ্চিত করাই হবে নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্যতম মূলমন্ত্র।

এ প্রসঙ্গে দলটির ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, “আমাদের রিপাবলিকে সাধারণ মানুষ, একমাত্র সাধারণ মানুষই হবে ক্ষমতার সর্বময় উৎস।” অর্থাৎ রাজনৈতিক চিন্তা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের কেন্দ্রে থাকবে জনগণ। কারও গায়ে অচ্ছুতের তকমা দেওয়া বা কোনও সম্প্রদায়কে রাষ্ট্রের সুবিধা থেকে বঞ্চিত রাখার অবকাশ আর থাকবে না। সমস্ত নাগরিকের নিরাপত্তা ও সমান অধিকারের নিশ্চয়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এনসিপি। দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে কৃষি, সেবা ও উৎপাদনখাতের মধ্যে সুষম সমন্বয় ঘটানোকে অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করে এনসিপি। তারা আয়-বৈষম্যহীন ও পরিবেশবান্ধব অর্থনীতির স্বপ্ন দেখাচ্ছে। যেখানে সম্পদ একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত না হয়ে সুষমভাবে পুনর্বণ্টিত হবে। বেসরকারি খাতের যে সিন্ডিকেট ও গোষ্ঠীস্বার্থ অতীতে জনগণের উপর শোষণ চালিয়েছে, তা ভেঙে দিয়ে ভোক্তা ও জনস্বার্থকে সুরক্ষা করা হবে কড়া পদক্ষেপের মাধ্যমে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে জোর দেওয়ার পাশাপাশি আঞ্চলিক সহযোগিতা ও আন্তর্জাতিক অংশীদারত্ব গড়ে তোলার মাধ্যমে এনসিপি চায় বাংলাদেশকে এ অঞ্চলের একটি ক্ষমতাধর রাষ্ট্রে পরিণত করতে। তাদের ভাষায়, “উদ্ভাবনী সংস্কৃতি গড়ে তোলা ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক বিকাশ সম্ভব নয়।” তাই শিক্ষা ও গবেষণার প্রসার ঘটিয়ে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে দলটি অগ্রাধিকার দিতে চায়।দেশের সার্বভৌমত্ব সুরক্ষায় শক্তিশালী প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপরও জোর দিয়েছে এনসিপি। তবে সেই প্রতিরক্ষা বলয় যেন ক্ষমতার অপব্যবহার বা রাজনৈতিক দমন-পীড়নের হাতিয়ারে পরিণত না হয়, সে বিষয়ে দলটির নেতারা সম্পূর্ণ সচেতন থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। একই সঙ্গে বিচারব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ প্রতিটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক কাঠামো রক্ষা করাকেও তারা অপরিহার্য বলে মনে করে।

নতুন দলের ঘোষণাপত্রে যে শব্দটি বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়েছে, তা হলো “ঐক্য”। নাহিদ ইসলাম বারবার উল্লেখ করেছেন, “একটি মানুষকেও পেছনে ফেলে রেখে আমাদের কাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যৎ অর্জিত হবে না। সকলের অংশগ্রহণ ও সকলের অধিকার প্রতিষ্ঠাই হবে আমাদের রাজনীতির প্রধান অনুপ্রেরণা।” তিনি বলেন, “আমরা পেছনে তাকাতে চাই না; আমরা সামনের দিকে এগিয়ে সম্ভাবনার বাংলাদেশের কথা বলতে চাই।” জুলাই ২০২৪-এর ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে ত্যাগ ও রক্তের ইতিহাস রচিত হয়েছে, তা এক নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের শক্তি জোগাবে বলে তিনি আশাবাদী।