রাসেল ভাইপার সম্পর্কিত সকল তথ্য, বর্তমান অবস্থা এবং প্রতিকারের উপায়

Posted by on in অন্যান্য 0
1st Image

রাসেল ভাইপার, ভাইপারিডি পরিবারভুক্ত ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম বিষধর সাপ এবং উপমহাদেশের ভয়ঙ্কর চারটি সাপের একটি। বাংলাদেশে অল্প যে কয়েকটি সাপ অত্যন্ত বিষধর, তার মধ্যে রাসেল ভাইপার অন্যতম। রাসেল ভাইপারের (Russell's Viper) বাংলা নাম চন্দ্রবোড়া বা উলুবোড়া। রাসেল ভাইপার সাপের বৈজ্ঞানিক নাম Daboia russelii । সম্প্রতি দেশে বিষাক্ত ও হিংস্র এ সাপের উপদ্রব বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে।

রাসেলস ভাইপারের নামকরণ:

প্যাট্রিক রাসেল ও তার বই

বিখ্যাত স্কটিশ সার্জন ও ন্যাচারালিস্ট প্যাট্রিক রাসেল ১৭৯৬ সালে তার 'অ্যান অ্যাকাউন্ট অফ ইন্ডিয়ান সারপেন্টস, কালেক্টেড অন দা কোস্ট অফ করোমান্ডেল'(An Account of Indian Serpents Collected on the Coast of Coromandel) বইয়ে চন্দ্রবোড়া সম্পর্কে লিখেছেন। পরবর্তীতে তারই নামে সাপটির নামকরণ করা হয় রাসেল ভাইপার। ১৯৮২ সালে, সর্বপ্রথম বাংলাদেশের বিখ্যাত প্রাণিবিদ আলি রেজা খান তার লিখিত ‘ওয়াইল্ড লাইফ অব বাংলাদেশ : এ চেকলিস্ট’ বইয়ে চন্দ্রবোড়া সাপ নথিভুক্ত করেন। রাসেল ভাইপারের গায়ে চাঁদের মতো দাগ থাকার কারণে এর নাম হয়েছে চন্দ্রবোড়া। 

রাসেলস ভাইপারের দৈহিক গঠন :

চন্দ্রবোড়ার দেহ মোটা এবং লেজ ছোট ও সরু। প্রাপ্তবয়স্ক সাপের দেহের দৈর্ঘ্য সাধারণত ১.২৪ মি (৪ ফুট ১ ইঞ্চি)। তবে দেহের দৈর্ঘ্য সর্বোচ্চ ১.৮ মিটার(৫ ফুট ৯ ইঞ্চি) পর্যন্তও হয়ে থাকে। এর মাথা চ্যাপ্টা, ত্রিভুজাকার এবং ঘাড় থেকে আলাদা। নাকের ছিদ্র বড় এবং মাথার শীর্ষবিন্দু স্বতন্ত্রভাবে খণ্ডিত আবরণে আচ্ছাদিত। মাথা আকারে বেশ বড় এবং রঙ হলুদ বা সোনালি হলুদ। আর এর চারপাশে থাকে দশ থেকে পনেরোটি বৃত্তাকার আঁশের বেষ্টনী। দুই জোড়া চোয়ালের ঢালের মধ্যে সামনের জোড়াটি একটু বেশি প্রসারিত। মুখের ভেতর দুটি ম্যাক্সিলারি হাড়ের সঙ্গে এক জোড়া করে মোট ৬টি বিষদাঁত। তবে একদম সামনের জোড়া দাঁতগুলো বেশ প্রকাণ্ড এবং সক্রিয় থাকে। দেহের পেছনে ছোট লেজের দৈর্ঘ্য সম্পূর্ণ দেহের মাত্র ১৪ শতাংশ।

রাসেলস ভাইপার চেনার উপায়:

রাসেলস ভাইপার চেনার উপায়:

রাসেল ভাইপারের শরীরে রয়েছে গভীর হলুদ এবং বাদামি মাটির রঙের প্যাটার্ন। শরীরের দৈর্ঘ্য বরাবর রয়েছে ৩ সারি গাঢ় বাদামি দাগ। আবার এই দাগগুলোর প্রত্যেকটির চারপাশে রয়েছে একটি করে কালো বলয়। এর বাইরের সীমানা সাদা বা হলুদ হয়ে প্রান্তের দিকে গাঢ় হয়ে গেছে। মাথায় রয়েছে এক জোড়া গাঢ় ছোপ, যার প্রত্যেকটি একটি করে গোলাপি বা বাদামি রঙের ‘‘ভি’’ বা ‘‘এক্স’’ আকৃতি হয়ে মাথার শীর্ষবিন্দুতে মিলেছে। শরীরের সামনে ও পেছনে সর্বাঙ্গজুড়ে সাদা, হলুদ বা গোলাপি রঙের সঙ্গে কালো দাগের অনিয়মিত ও বিক্ষিপ্ত নকশা।

রাসেলস ভাইপারের বাসস্থান ও বিস্তৃতি:

রাসেলস ভাইপারের বাসস্থান ও বিস্তৃতি

রাসেল ভাইপার ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও নেপালে দেখা যায়। তবে এ সাপটিকে থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, চীন ও মিয়ানমারেও দেখা যায়। আগে শুধুমাত্র বাংলাদেশের রাজশাহী অঞ্চলে এ সাপ দেখা যেত। যে কারণে এটি বরেন্দ্র অঞ্চলের সাপ বলেই পরিচিত ছিল। চন্দ্রবোড়া ভারত ও বাংলাদেশে মহাবিপন্ন প্রাণীর তালিকায় রয়েছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, সাপের এই প্রজাতিটি বাংলাদেশ থেকে বহু বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছিল। কিন্তু গত ১০-১২ বছর আগে থেকে আবারো এই সাপের কামড়ের ঘটনার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমানে পদ্মা অববাহিকা ধরে দক্ষিণাঞ্চলের অনেক জেলায় রাসেল ভাইপার বিস্তৃত হচ্ছে। বাংলাদেশে রাজশাহী, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, মানিকগঞ্জ, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ভোলাতে রাসেল ভাইপার উপস্থিতি পাওয়া দেখা গেছে।

রাসেলস ভাইপার সাধারণত ঘাস, ঝোপ, বন, ম্যানগ্রোভ ও ফসলের ক্ষেতে, বিশেষত নিচু জমির ঘাসযুক্ত উন্মুক্ত ও কিছুটা শুষ্ক পরিবেশে বাস করে। রাসেল ভাইপার উন্মুক্ত ও কিছুটা শুষ্ক পরিবেশে থাকতে পছন্দ করে। স্থলভাগের সাপ হলেও এটিকে জলে দ্রুতগতিতে চলতে পারে। ফলে বর্ষাকালে কচুরিপানার সঙ্গে বহুদূর পর্যন্ত ভেসে নিজের স্থানান্তর ঘটাতে পারে।

রাসেলস ভাইপারের বংশবিস্তার:

রাসেলস ভাইপারের বংশবিস্তার:

বেশির ভাগ সাপ ডিম পাড়লেও রাসেল ভাইপার বাচ্চা দেয়। গর্ভধারণ শেষে স্ত্রী রাসেল ভাইপার সাধারণত ২০ থেকে ৪০টি বাচ্চা দেয়। তবে ৮০টি পর্যন্ত বাচ্চা দেয়ার রেকর্ডও আছে। এরা বছরের যে কোনো সময় প্রজনন করে। তবে মে থেকে পরের তিন মাস প্রজনন সবচেয়ে বেশি ঘটে। একদিকে উচ্চ প্রজনন ক্ষমতা, সেইসঙ্গে ইঁদুর, ব্যাঙসহ সাপের পর্যাপ্ত খাবারের উপস্থিতি থাকায় বাড়ছে রাসেল ভাইপার। অন্যদিকে এ সাপের শত্রু শিয়াল, বেজি, গুইসাপের সংখ্যা প্রকৃতিতে কমে যাওয়ায় এর বিস্তারে সহায়ক হচ্ছে। 

রাসেলস ভাইপারের স্বভাব এবং আক্রমণের কারণ:

রাসেল ভাইপার নিশাচর, এরা খাদ্য হিসেবে ইঁদুর, ছোট পাখি, টিকটিকি ও ব্যাঙ ভক্ষণ করে। এই সাপ সাধারণত নিচু ভূমির ঘাসবন, ঝোপ-জঙ্গল, উন্মুক্ত বন, কৃষি এলাকায় থাকে। সাধারণত মানুষের বসতি এড়িয়ে চলে। তবে বসতবাড়ির আশেপাশে এদের খাবারের প্রাচুর্যতা বেশি থাকায় খাবারের খোঁজে এরা অনেক সময় লোকালয়ে চলে আসে। এ সাপের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- মেটে রঙের হওয়ায় এরা যে কোনো স্থানের সঙ্গে অবিকলভাবে মিশে যেতে পারে। রাসেলস ভাইপার দক্ষ সাঁতারু সাপ। তাই এটি নদীর স্রোত ও বন্যার পানিতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়েছে।

রাসেল ভাইপার সাধারণত স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আক্রমণ করে না। কোনো শত্রুর কাছ থেকে হুমকি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এরা একটি 'S' আকৃতির কুণ্ডলী পাকিয়ে খুব জোরে জোরে হিস্ হিস্ শব্দ করে। শরীরের ওপরের এক-তৃতীয়াংশকে উত্থাপন করে উচ্চ শব্দে আক্রমণের ঘোষণা দিতে থাকে। এইভাবে শরীরের নির্দিষ্ট অংশকে ওপরে তুলে ধরাটা প্রতিটি সাপেরই আক্রমণের একটি সাধারণ ভঙ্গিমা। তবে অন্যান্য সাপের তুলনায় রাসেলস ভাইপার তার শরীরের বেশিরভাগ অংশ মাটি থেকে তুলতে পারে। রাসেলস ভাইপার দিনে ও রাতে উভয় সময়ে কামড়ায়। অন্য সাপ মানুষকে দংশনের পর সেখান থেকে দ্রুত সরে যায়, কিন্তু এ সাপ অনেক সময় দংশন করে ধরে রাখতে পারে।

বিষধর সাপ হিসেবে পৃথিবীতে রাসেল ভাইপারের অবস্থান পঞ্চম। কিন্তু হিংস্রতা আর আক্রমণের দিক থেকে এর অবস্থান প্রথম। আক্রমণের ক্ষেত্রে এই সাপ এতটাই ক্ষিপ্র যে, ১ সেকেন্ডের ১৬ ভাগেরও ১ ভাগ সময়ে কামড়ের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারে এটি।

রাসেলস ভাইপারের বিষ ও বিষের প্রভাব:

 

রাসেলস ভাইপারের বিষদাঁত সঞ্চালকদন্তী (Solenoglyphous), অর্থাৎ মুখ বন্ধ করলে দাঁত ভাঁজ হয়ে মুখের সঙ্গে সমান্তরালভাবে অবস্থান করে। একটি চন্দ্রবোড়া সাপ এক ছোবলে বেশ খানিকটা বিষ ঢালতে পারে। পূর্ণবয়স্ক সাপের ক্ষেত্রে বিষের পরিমাণ ১৩০-২৫০ মিলিগ্রাম, ১৫০-২৫০ মিলিগ্রাম এবং ২১-২৬৮ মিলিগ্রাম মাপা হয়েছে।

রাসেলস ভাইপার সাপের বিষ অত্যন্ত শক্তিশালী এবং হেমাটোটক্সিক, যার কারণে ছোবল দিলে আক্রান্ত স্থানে পঁচন ধরে।  এ সাপের বিষের উপাদান ‘এনজাইম’ টিস্যুর মাধ্যমে দ্রুত বিস্তার নিশ্চিত করে। আরেক উপাদান ‘ফসফোলিপেজ’ সেল মেমব্রেন ধ্বংস করে এবং হেমোলাইসিস সৃষ্টি করে, যা রক্ত কোষের ক্ষতি করে। অন্য উপাদান ‘প্রোটিনেজ’ দেহের প্রোটিন ভেঙে ফেলে, যা টিস্যু ধ্বংস এবং রক্ত জমাট বাধার ক্ষমতা হ্রাস করে। 

রাসেল ভাইপার সাপে কামড়ানোর লক্ষণ:

রাসেলস ভাইপার কামড়ানোর পর শরীরে তীব্র টনটনে ব্যাথা অনুভূত হয়। ছোবলের পাঁচ মিনিটের মধ্যে ফুলে যায় ক্ষতস্থান। রক্তক্ষরণ এর একটি সাধারণ লক্ষণ। এছাড়া রক্তচাপ ও হৃৎস্পন্দনের হার কমে যায়।  প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রে বমি হয় ও মুখমণ্ডল ফুলে যায়। এই সাপের কামড়ে শরীরের দংশিত অংশে বিষ ছড়িয়ে অঙ্গহানি, ক্রমাগত রক্তপাত, রক্ত জমাট বাঁধা, স্নায়ু বৈকল্য, চোখ ভারী হয়ে যাওয়া, পক্ষাঘাত, কিডনি ও ফুসফুসের সংক্রমণসহ বিভিন্ন ধরনের শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে। যথাযথ চিকিৎসা না নিলে ২৫-৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে কিডনি অকার্যকর হয়ে যায়। চিকিৎসকের মতে, গোখরো সাপের দংশনের গড় ৮ ঘণ্টা পর, কেউটে সাপের দংশনের গড় ১৮ ঘণ্টা পর ও  রাসেল ভাইপার সাপের দংশনের গড় ৭২ ঘণ্টা বা তিন দিন পর রোগীর মৃত্যু হতে পারে।

বাংলাদেশে রাসেলস ভাইপারের উপদ্রব:

বাংলা একাডেমি থেকে ১৯৯২ সালে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের সাপ’ বইয়ে বন্য প্রাণিবিশেষজ্ঞ মো. আলী রেজা খান বলেছেন, রাসেলস ভাইপার রাজশাহী বিভাগে সর্বাধিক পাওয়া যায়। অন্যত্র আছে, তবে তেমন দেখা যায় না।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ভেনম রিসার্চ সেন্টার বলেছে, ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ৯টি জেলায় রাসেলস ভাইপার দেখা গেছে। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে আরো দুইটি জেলায় এই সাপ দেখা যায়, ফলে তখন ১১ টি জেলায় রাসেলস ভাইপার আছে বলে নথিভুক্ত করা হয়। ২০২৩ সালে ২৩টি জেলায় এই সাপ নথিভুক্ত করেছিলেন ভেনম রিসার্চ সেন্টারের গবেষকেরা। সর্বশেষ ২০২৪ সালে জেলার সংখ্যা আরও বাড়ে।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ভেনম রিসার্চ সেন্টার দাবি করেছেন, পদ্মা নদী ও তার শাখা নদীর তীরবর্তী জেলাগুলোতে রাসেলস ভাইপার বিস্তার সবচেয়ে বেশি। ২০১৩ থেকে ২০২৪ সালের মে পর্যন্ত বাংলাদেশের ৩২টি জেলায় এই সাপ দেখা গেছে। জেলার তালিকায় আছে: নীলফামারী, দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, পাবনা, নাটোর, যশোর, সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, চট্টগ্রাম, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, মানিকগঞ্জ, ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, চাঁদপুর, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ভোলা, বরিশাল, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি ও বরগুনা।


রাসেলস ভাইপারের কামড় খেলে করণীয় চিকিৎসা:

সাপ গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন রাসেলস ভাইপার সাপ কামড়ালে তারও চিকিৎসা আছে এবং সময়মত চিকিৎসা নিতে পারলে মৃত্যু ঝুঁকি কমে আসে। বাংলাদেশে সর্প দংশন প্রতিরোধী যে অ্যান্টিভেনম রয়েছে সেগুলো অন্যান্য সাপের বিরুদ্ধে ভালোভাবে কাজ করলেও রাসেলস ভাইপারের বিরুদ্ধে ভালোমতো কাজ করে না। এই এন্টিভেনমটিতে ভারতীয় রাসেলস ভাইপারের বিরুদ্ধে উপাদান রয়েছে। ভারতীয় রাসেলস ভাইপারের বিষ এবং বাংলাদেশের রাসেলস ভাইপারের বিষের ভিতরে উপাদানগত বৈসাদৃশ্য বেশি হওয়ায় এটি পুরাপুরি কাজ করে না। আমাদের দেশে ভারতের Haffkine Institute এ তৈরি বিষধর সাপের বিষ প্রতিরোধের জন্য Polyvalent Antivenom প্রয়োগ করা হয়। ২০১৬ সালে কোস্টারিকার Clodomiro Picado Institute একটি নতুন অ্যান্টিভেনম তৈরি করেছে এবং শ্রীলঙ্কায় তা পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে।

রাসেল ভাইপারের এন্টিভেনমের নাম এবং যেখানে পাওয়া যাবে:

অ্যান্টিভেনম বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তালিকায় এসেনশিয়াল ড্রাগ বা অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ। কার্যকারিতার উপর ভিত্তি করে অ্যান্টিভেনম দুই রকম হয়ে থাকে। যথা-
১। মনোভ্যালেন্ট অ্যান্টিভেনম (Monovalent antivenom) – যে অ্যান্টিভেনমগুলো শুধু একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির সাপের বিষের বিরুদ্ধে কার্যকর এবং 
২। পলিভ্যালেন্ট অ্যান্টিভেনম(Polyvalent Antivenom)  – যে অ্যান্টিভেনমগুলো একাধিক প্রজাতির সাপের বিষের বিরুদ্ধে কার্যকর।

অ্যান্টিভেনম

রাসেল ভাইপারের কামড়ে আক্রান্ত ব্যাক্তির শরীরে পলিভ্যালেন্ট অ্যান্টিভেনম(Polyvalent Antivenom) প্রয়োগ করা হয়। সাপ কামড়ানোর পর একজন রোগীকে ১০টি করে অ্যান্টিভেনম ইনজেকশন দিতে হয়। ১০টি ভায়াল মিলে হয় ১টি ডোজ। তবে বিষের পরিমাণ এবং বিষাক্ততার মাত্রা বেশী হলে সাপে কামড়ানো ব্যক্তির উপর এক বা একাধিক ডোজ অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করার প্রয়োজন হতে পারে।

সরকারিভাবেই সরকার ভারত থেকে পলিভ্যালেন্ট অ্যান্টিভেনম আমদানি করে। সাধারণত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা সদর হাসপাতাল বা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রাসেলস ভাইপারের অ্যান্টিভেনম বিনামূল্যে পাওয়া যায়। তবে যদি কোনো কারণে সরকারি হাসপাতাল গুলোতে এ অ্যান্টিভেনম না পাওয়া যায় তবে বাইরে থেকে অ্যান্টিভেনম কিনতে পাওয়া যায়।

রাসেলস ভাইপারের কামড় খেলে নিম্নবর্তী কাজগুলো করতে পারেন-

১। শরীরের যে স্থানে সাপ কামড়েছে সেটি যতটা কম সম্ভব নড়াচড়া করুন।
২। আক্রান্ত স্থান সাবান দিয়ে আলতোভাবে ধুতে হবে অথবা ভেজা কাপড় দিয়ে আলতোভাবে মুছে ফেলতে হবে।
৩। ঘড়ি বা অলঙ্কার পড়ে থাকলে তা খুলে ফেলুন।
৪। সাপে কাটলে ওঝার কাছে গিয়ে অযথা সময় নষ্ট করবেন না। যত দ্রুত সম্ভব নিকটস্থ হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রে যান।
৫। যেহেতু রাসেলস ভাইপার সাপের কামড়ে রোগীর কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, তাই রোগীকে এমন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত যেখানে ডায়ালাইসিসের সুব্যবস্থা রয়েছে।
৬। আতঙ্কিত হবেন না। রাসেলস ভাইপারের বিষ প্রতিষেধক বা অ্যান্টিভেনম নিকটস্থ সরকারি হাসপাতালে বিনা মূল্যে পাওয়া যায়।

রাসেলস ভাইপারের কামড় খেলে নিম্নবর্তী কাজগুলো করবেন না-

১। যেখানে কামড় খেয়েছেন, শরীরের সেই জায়গাটি নড়াচড়া করা যাবে না। পায়ে কামড়ালে বসে পড়তে হবে, হাঁটা যাবে না। হাতে কামড়ালে হাত নড়াচাড়া করা যাবে না। হাত-পায়ের গিরা নড়াচড়ায় মাংসপেশির সংকোচনের ফলে বিষ দ্রুত রক্তের মাধ্যমে শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
২। কামড়ের স্থান থেকে চুষে বিষ বের করে আনার চেষ্টা করা।
৩। আক্রান্ত অংশে গিঁট বা বাঁধ দেয়া যাবে না। কারণ বাঁধের কারণে মাংসপেশির ভিতরে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়ে অঙ্গহানি হতে পারে।
৪। কামড়ের স্থান আরও কেটে বা সেখান থেকে রক্তক্ষরণ করে বিষ বের করে আনার চেষ্টা করা।
৫। বরফ, তাপ বা কোনও ধরনের রাসায়নিক কামড়ের স্থানে প্রয়োগ করা।
৬। আক্রান্ত ব্যক্তিকে একা ফেলে যাওয়া।

রাসেল ভাইপারের কামড় থেকে প্রতিকারের উপায়:

ভয়ঙ্কর বিষধর সাপ রাসেল ভাইপার ইতিমধ্যে নদীর স্রোতে ও বন্যার পানিতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। তাই, সবাইকে সাবধানতা অবলম্বন করার জন্য অনুরোধ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। বিবৃতিতে বলা হয়, রাসেল ভাইপারের উপস্থিতি উদ্বেগজনক হলেও এটি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, মানুষের সঙ্গে এই সাপের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা কম। এই সাপ সাধারণত নিচুভূমির ঘাস, বন, ঝোপ-জঙ্গল, উন্মুক্ত বন, কৃষি এলাকায় বাস করে এবং মানুষের বসতি এড়িয়ে চলে। সাপটি মেটে রঙের হওয়ায় মাটির সঙ্গে সহজে মিশে যেতে পারে। মানুষ খেয়াল না করে সাপের খুব কাছে গেলে সাপটি বিপদ দেখে ভয়ে আক্রমণ করে।

সাপের কামড় এড়াতে করণীয়-

১।  যেসব এলাকায় রাসেল ভাইপার দেখা গিয়েছে, সেসব এলাকায় চলাচলে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করুন।

২।  লম্বা ঘাস, ঝোপঝাড়, কৃষি এলাকায় হাঁটার সময় সতর্ক থাকুন।

৩।  সংশ্লিষ্ট এলাকায় কাজ করার সময় বুট ও লম্বা প্যান্ট পরুন।

৪।  রাতে চলাচলের সময় অবশ্যই টর্চ লাইট ব্যবহার করুন।

৫।  বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার ও আবর্জনামুক্ত রাখুন।

৬।  পতিত গাছ, জ্বালানি লাকড়ি, খড় সরানোর সময় বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করুন।

৭।  সাপ দেখলে তা ধরা বা মারার চেষ্টা করবেন না। এবং

৮।  প্রয়োজনে জাতীয় হেল্প লাইন ৩৩৩ নম্বরে কল করুন বা নিকটস্থ বন বিভাগের অফিসকে অবহিত করুন।

রাসেল ভাইপারের প্রাদুর্ভাব কমাতে করণীয়-
বেজি, গুইসাপ, বাগডাশ, গন্ধগোকুল, বন বিড়াল, মেছো বিড়াল, তিলা নাগ ঈগল, সারস, মদন টাক এবং কিছু প্রজাতির সাপ 'রাসেল'স ভাইপার' খেয়ে এদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখে। এসকল বন্যপ্রাণীকে মানুষের নির্বিচারে হত্যার কারণে প্রকৃতিতে রাসেল ভাইপার বেড়ে যাচ্ছে। তাই বন্যপ্রাণী দেখলেই অকারণে তা হত্যা, এদের আবাসস্থল ধ্বংস করা থেকে বিরত থাকুন। 
স্মরণ রাখা প্রয়োজন, রাসেল ভাইপার বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ এর ৬(১) ধারা অনুযায়ী সংরক্ষিত প্রাণী। রাসেল ভাইপার ইঁদুর খেয়ে যেমন ফসল রক্ষা করে, তেমনি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই সাপের বিষ হতে অনেক জীবন রক্ষাকারী ঔষধ তৈরি হয়। সাপ মারা দণ্ডনীয় অপরাধ, সাপ মারা হতে বিরত থাকুন।