হৃদরোগ কী? হার্টের জন্য ক্ষতিকর খাবারের তালিকা

By MD Alim

Updated on:

নিচের যে অংশটি সম্পর্কে জানতে চান, ক্লিক করুন

হৃদরোগ বা (Cardiovascular disease ) কী?

হৃদরোগ বা Cardiovascular disease হলো মানুষের হৃদপিণ্ড ও রক্তনালীর সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন ধরণের রোগের একটি সাধারণ নাম। একে সংক্ষেপে CVD ও বলা হয়। যেকেউই হৃদরোগে আক্রান্ত হতে পারে। সাধারণত মধ্যবয়স বা এর পর থেকে হৃদরোগ প্রকাশ পেয়ে থাকে। মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের হৃদরোগের প্রবণতা তুলনামূলক বেশি থাকে। তবে বয়স বাড়ার সাথে সাথে মহিলাদেরও হৃদরোগের ঝুকি বাড়তে থাকে।

হৃদরোগের ধরণ ও এদের কারণ সমূহ কী কী?

হৃদরোগ হলো মূলত মানুষের হুদপিন্ড ও রক্তনালীর অস্বাভাবিক অবস্থা যা হৃদপিন্ডর স্বাভাবিক কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্থ করে। নিচে হৃদরোগের ধরণ ও এদের কারণসমূহ নিয়ে লেখা হলো।

১) করোনারি আর্টারি ডিজিজ (Coronary Artery Disease বা CAD)

এটি হৃদপিন্ডের অতপরিচিত একটি রোগ। যখন হৃদপিন্ড কোন কারণে সরু বা ব্লক হয়ে যায় তখন প্রয়োজনীয় অক্সিজেন ও রক্ত হৃদপিন্ডের পেশীতে পৌছাতে পারেনা।
হৃদপিন্ডের এমন অবস্থাকে তখন করোনারি আর্টারি ডিজিজ বা সিএডি বলা হয়। এটি হার্ট অ্যাটাকের প্রধান কারণ।

করোনারি আর্টারি ডিজিজের কারণ
  • করোনারি অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস (Coronary Atherosclerosis): যখন রক্তনালীর মধ্যে ফ্যাটি পদার্থ জমে ধমনী সরু হয়ে যায়। এর ফলে রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়।
  • কোলেস্টেরল: রক্তে উচ্চমাত্রায় কোলেস্টেরল জমে ধমনীগুলি ব্লক হলেও সিএডি হয়।
  • ধূমপান: ধূমপান একদিকে রক্তনালীকে ক্ষতিগ্রস্থ করে অন্যদিকে রক্ত জমাট বাধতে সহায়তা করে।
  • অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও ডায়বেটিস : উচ্চমাত্রায় ফ্যাট ও চিনি জাতীয় খাবার শরীরে হৃদরোগের ঝুকি বাড়ায়। পাশাপাশি ডায়বেটিস অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিসের ঝুঁকি বাড়ায়।
২) ইস্কেমিক হার্ট ডিজিজ (IHD বা Ischemic Heart Disease)

যখন হৃৎপিণ্ডে পর্যাপ্ত পরিমাণে রক্ত প্রবাহিত হয় না এবং হৃদপিণ্ডের পেশী পর্যাপ্ত অক্সিজেন পায় না তখন যেই অবস্থার সৃষ্টি হয় তাকে ইস্কেমিক হার্ট ডিজিজ বলে। এ অবস্থার সৃস্টি হলে রোগীর মাঝে মাঝে বুকে ব্যথা বা অস্বস্তি অনুভূতি হয়।

ইস্কেমিক হার্ট ডিজিজ এর কারণ

হৃৎপিন্ড নিজেই নিজেকে দুটি রক্তনালির মাধ্যমে অক্সিজেনসহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য খাদ্য উপাদান সরবরাহ করে থাকে। হৃদপিণ্ডের এ রক্তনালির দেয়ালে প্লাক অথবা কোলেস্টেরল জমে রক্তনালিকে ব্লক করলে বুকে ব্যাথার সৃস্টি হয়। অর্থাৎ দুটি রক্তনালির কমপক্ষে একটিতে আংশিক বা পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে গেলেই এ সমস্যা হয়।

৩) হার্ট অ্যাটাক (Myocardial Infarction)

এটি CAD এর পরবর্তী ধাপ। যখন CAD চরম পর্যায়ে পৌছায় তখন পর্যাপ্ত রক্ত ও অক্সিজেনের অভাবে হার্ট অ্যাটাক হয়।

হার্ট অ্যাটাকের কারণ
  • রক্ত জমাট : যখন কোনো ধমনীতে রক্ত জমাট বেঁধে হৃদপিণ্ডের কোনো অংশে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায় তখন হার্ট অ্যাটাক ঘটে।
  • করোনারি আর্টারি ব্লকেজ: যদি ধমনীর মধ্যে ফ্যাটি প্লাক জমে ব্লক হয়ে যায় তখন এর কারণে হৃদপিণ্ডে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। ফলাফল হার্টঅ্যাটাক।
৪) হার্ট ফেইলিউর (Heart Failure)

যখন হার্ট বা হৃদপিন্ড কোন কারণে পর্যপ্ত পরিমানে রক্ত দেহে পাম্প করতে অক্ষম হয় তখন তাকে হার্ট ফেইলিউর বলে। এতে আক্রান্ত ব্যাক্তির শরীরে পর্যাপ্ত রক্ত ও অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়। এর ফলে ক্লান্তি, শ্বাসকষ্ট ও শরীর ফুলে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটে।

হার্ট ফেইলিউরের কারণ
  • হার্টের ভালভ সমস্যা: যদি কোন কারণে ভালভ ঠিকমতো কাজ না করে তাহলে হার্ট সঠিকভাবে পাম্প করতে পারেনা।
  • ডায়াবেটিস: ডায়বেটিস রক্তের নালিকে ক্ষতিগ্রস্থ করে এবং শরীরে প্রয়োজনীয় ইনসুলিন না থাকায় হৃদপিণ্ডের কার্যক্ষমতাকে কমে যায়।
  • মায়োকার্ডাইটিস (Myocarditis): এটি মূলত হৃদপিণ্ডের পেশীর প্রদাহ যা ভাইরাস সংক্রমণ থেকে হয়ে থাকে। এতে আক্রান্ত হলে হৃদপিন্ড সঠিকভাবে পাম্প করতে পারেনা।
  • পাশাপাশি উচ্চ রক্তচাপ ও করোনারি আর্টারি ডিজিজও হার্ট ফেইলিউরের জন্য দায়ি।
৫) এ্যারিদমিয়া (Arrhythmia)

এ্যারিদমিয়া হলো হৃদপিণ্ডের এমন অবস্থা যখন হৃদপিন্ডে রিদম বা ধমনির ছন্দ অস্বাভাবিক হারে পরিবর্তন হয়। এক্ষেত্রে তিনটি অবস্থা হয়ে থাকে যথা: অত্যন্ত দ্রুত (tachycardia), ধীরে (bradycardia) ও অনিয়মিতভাবে (atrial fibrillation)। এদের অবস্থার উপর ভিত্তি করে কখনো হৃদপিণ্ডে রক্ত প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

এ্যারিদমিয়া এর কারণ
  • ইলেক্ট্রোলাইট ভারসাম্যহীনতা: যদি শরীরে পটাশিয়াম বা সোডিয়ামের মতো ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয় তাহলে এ্যারিদমিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
  • জেনেটিক সমস্যা: কিছু মানুষ বংশগতভাবে অস্বাভাবিক হৃদরিদমের ঝুঁকি বহন করে। যা পরবর্তীতে এ্যারিদমিয়ায় রুপ নেয়।
৬) ভালভুলার হার্ট ডিজিজ (Valvular Heart Disease)

হৃদপিণ্ডের চারটি ভালভের মধ্যে যদি কোনো একটি ভালভ সঠিকভাবে কাজ না করে তাহলে রক্ত প্রবাহে সমস্যা দেখা দেয়। এটি সাধারণত ভালভের সংকোচন (stenosis) অথবা ভালভ থেকে রক্ত প্রবাহের বিপরীত প্রবাহ (regurgitation) কারণে হয়ে থাকে।

ভালভুলার হার্ট ডিজিজের কারণ
  • জন্মগত ত্রুটি: কারও কারও ক্ষেত্রে জন্মের সময় থেকেই ভালভের ত্রুটি থাকতে পারে।
  • রিউম্যাটিক ফিভার: রিউম্যাটিক ফিভার থাকলে তা ভালভের ক্ষতি করে। ফলে পরবর্তীতে এটি স্থায়ী সমস্যায় রুপান্তরিত হয়।
  • এন্ডোকার্ডাইটিস: এটি হলো হৃদপিণ্ডের অভ্যন্তরীণ আবরণের একটি ইনফেকশন যা ভালভকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
৭) পেরিকার্ডিয়াল ডিজিজ (Pericardial Disease)

মূলত পেরিকার্ডিয়াম হলো হৃদপিণ্ডকে ঘিরে থাকা একটি পাতলা আবরণ। এই আবরণে যদি কোন কারণে সংক্রমণ বা অন্যকোন রোগ হয় তখন তাকে
পেরিকার্ডাইটিস (Pericarditis) হয়। এতে আক্রান্ত হলে বুক ব্যাথা ও শ্বাসকষ্ট জনীত সমস্যা দেখা দেয়।

পেরিকার্ডিয়াল ডিজিজের কারণ
  • আঘাত : বড় কোন শারীরিক আঘাতের কারণে শরীরের অভ্যন্তরে পেরিকার্ডিয়ামে ড্যামেজ হলে সেখান থেকে ডিজিজ হতে পারে।
  • অটোইমিউন : লুপাস বা রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস পেরিকার্ডিয়ামে সংক্রমণ ঘটাতে পারে।.
৮) কনজেনিটাল হার্ট ডিফেক্ট ডিজিজ (CHD Disease বা Congenital Heart Defect Disease)

এটি মূলত হলো একটি জন্মগত হৃদরোগ যা শিশুদের মধ্যে পাওয়া যায়। জন্মগতভাবে হৃদপিণ্ডের গঠনগত সমস্যা হলে তাকে কনজেনিটাল হার্ট ডিজিজ বলে। এতে আক্রান্ত শিশুদের হৃদপিণ্ডের মধ্যে ছিদ্র, ভালভের অস্বাভাবিকতা বা কখনো রক্তনালীতে ত্রুটি থাকে।

কনজেনিটাল হার্ট ডিজিজের কারণ
  • জেনেটিক সমস্যা : পারিবারিক কারণে জন্মগতভাবে হৃদপিণ্ডের গঠনগত ত্রুটির কারণে এটি হতে পারে।
  • মাতৃগর্ভে সংক্রমন অথবা পার্শপ্রতিক্রিয়া : মাতৃগর্ভে থাকাকালীন শিশু কোন প্রকার সংক্রমণ বা ঔষুধের পার্শপ্রতিক্রিয়ার কারণে শিশুর হৃদপিণ্ডের বিকাশ বাধাগ্রস্থ হতে পারে।
৯) হাইপারটেনসিভ হার্ট ডিজিজ (Hypertensive Heart Disease)

দীর্ঘদিন যাবৎ উচ্চ রক্তচাপে ভুগলে ঐ ব্যাক্তির হৃদপিন্ডের পেশী পুরো হয়ে যায়। এতে করে হৃদপিণ্ডের কার্যক্ষমতা কমে যায় এবং হার্ট ফেইলিউরের সম্ভাবনা দেখা দেয়।

হাইপারটেনসিভ হার্ট ডিজিজের কারণ
  • উচ্চ রক্তচাপ: দীর্ঘমেয়াদী উচ্চ রক্তচাপ হৃদপিণ্ডের পেশীকে পুরু এবং শক্ত করে তোললে এটি দেখা দেয়। এর অন্য আর কোন কারণ নেই।
১০) রিউম্যাটিক হার্ট ডিজিজ (Rheumatic Heart Disease)

রিউম্যাটিক হার্ট ডিজিজ হলো স্ট্রেপ থ্রোট ইনফেকশনের পর রিউম্যাটিক ফিভার থেকে সৃষ্ট একটি দীর্ঘমেয়াদী জটিলতা। এটি রিউম্যাটিক ফিভারের কারণেই হয়ে থাকে যা ভালভকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

হার্টের জন্য ক্ষতিকর খাবারের তালিকা

বাংলাদেশে দিন দিন হৃদরোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। যার মধ্যে প্রধান কারণই হলো খাদ্যাভ্যাস। আর এই খাদ্যাভ্যাসকে সংশোধন করে হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকটাই কমানো সম্ভব। নিচে হার্টের জন্য ক্ষতিকর এমন খাবারের তালিকা দেয়া হলো।

  • ফ্যাট/চর্বি
    প্রাণীজ মাংশে পাওয়া যায় এমন চর্বি অথবা আর্টিফিশিয়াল খাবার এবং ভাজাপোড়া, ফাস্ট ফুড, কুড়কুড়ে বা মচমচে কেনা খাবার ও বেকারি ফুড ইত্যাদিতে থাকা চর্বি রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল (LDL) এর মাত্রা বাড়িয়ে দেয় ও ভালো কোলেস্টেরল (HDL) এর মাত্রা কমিয়ে দেয়। ফলসরুপ ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে গিয়ে তা হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।
    ফ্যাট/চর্বি খাবারের উৎস : ফাস্ট ফুড, চিপস, ফ্রোজেন পিৎজা বা অন্য ফাস্ট ফুড। মাখন, লাল মাংস (গরু, খাসি), চিজ ও ফ্যাট দুধ। এর পাশাপাশি বেকারির বিস্কুট, কেক, পাই ইত্যাদি।
  • সোডিয়াম বা লবণ
    অতিরিক্ত লবণ দেহে রক্তচাপ বাড়ায়। যা পরবর্তীতে হৃদপিণ্ডের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে এটি হৃদপিণ্ডের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয় ও হার্ট ফেইলিউরের ঝুঁকি বাড়ায়।
    সোডিয়ামের উৎস : খাবার লবণ, বেকিং পাউডার, বেকিং সোডা, টেস্টিং সল্ট, সয়া সস, সস, বাটার, ফিশ বস, গরুর মাংস, কলিজা, মগজ, প্রসেস ফুড, খাসির মাংস ইত্যাদিতে সাধারণ খাবারের তুলনায় বেশি সোডিয়াম থাকে। তাই এ সকল খাবার গ্রহণ ও খাবারের সাথে কাঁচা লবণ ব্যবহারে সতর্ক হতে হবে।
  • কার্বোহাইড্রেট
    কার্বোহাইড্রেট খাবার থেকে রক্তে দ্রুত গ্লকোজ তৈরি হয়। যা ট্রাইগ্লিসারাইডস (TG)–এর মাত্রা বাড়িয়ে দেয় ফলসরূপ তা হৃদরোগের সৃষ্টি করে।
    কার্বোহাইড্রেট খাবারের উৎস: চিনি, চকলেট, গুড়, কোল্ড ড্রিংকস, মিষ্টি, এনার্জি ড্রিংকস, কমার্শিয়াল ফ্রুট জুস ও সরল শর্করা জাতীয় খাবার।
  • অ্যালকোহল
    অতিরিক্ত অ্যালকোহল পান রক্তচাপ বাড়ায়। দীর্ঘদিন যাবৎ অ্যালকোহল গ্রহণ হৃদপিণ্ডের কার্যকারিতা কমাতে পারে। পাশাপাশি এটি ওজন বাড়ায় এবং শরীরে ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা বৃদ্ধি করে। যা হার্টের জন্য রেড জোনের মতো।
  • স্যাচুরেটেড ফ্যাট
    স্যাচুরেট ফ্যাট জাতীয় খাবারে সোডিয়াম ও কোলেস্টেরলের আধিক্য থাকে। যা একত্রে রক্তচাপ ও হৃদরোগের ঝুকি বৃদ্ধি করে।
    স্যাচুরেট ফ্যাট খাবারের উৎস : গরুর মাংস, খাসির মাংস, সসেজ ও নানান প্রক্রিয়াজাত করা মাংস।

Leave a Comment