মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি

By MD Alim

Updated on:

বর্তমান বিশ্বে সাংবিধানিক গণতন্ত্রের চর্চা রয়েছে এমন দেশের মধ্যে সর্বাধিক শক্তিশালী ও মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তি হলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দেশ ও রাজনৈতিক উভয় ব্যবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হলো রাষ্ট্রপতি। মার্কিন রাষ্ট্রপতি হলেন দেশটির সরকার প্রধান যিনি ফেডারেল শাখাগুলোর মধ্যেকার নির্বাহী শাখাগুলোর প্রধান। তার দ্বায়িত্ব হলো সংবিধানের মাধ্যমে প্রদত্ত এবং কংগ্রেস কর্তৃক লিখিত রাষ্ট্রীয় আইনের যথাযথ প্রয়োগ করা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কোনো নিয়মতান্ত্রিক বা শুধু নামসর্বস্ব রাষ্ট্রপ্রধানের অস্তিত্ব নেই। সেখানে রাষ্ট্রপতিই হলো প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী বা উৎস। অন্যদিকে বাংলাদেশে যেখানে রাষ্ট্রপতি নাম মাত্র ক্ষমতার অধিকারী । প্রকৃত অর্থে ক্ষমতার অধিকারী হলেন প্রধানমন্ত্রী। উপরোক্ত আলোচনা থেকে বুঝা যায় যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জটিল এই নির্বাচনের প্রক্রিয়াটা ঠিক কীভাবে কাজ করে তা হয়তো অনেকেই পুরোপুরি বুঝতে পারেননা। তাই নিচে মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পদ্ধতি পর্যায়ক্রমিকভাবে আলোচনা করা হলো-

মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের তারিখ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হয়ে থাকে প্রতি ৪ বছর পরপর। এবং নির্বাচনের তারিখটি হয় সেই বছরের নভেম্বরের প্রথম সোমবারের পরের মঙ্গলবার। অর্থাৎ নভেম্বর মাসের প্রথম মঙ্গলবার সাধারণত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তবে নভেম্বর মাসের প্রথম মঙ্গলবার যদি ১ তারিখ হয়, তখন নির্বাচনের তারিখ হয় নভেম্বর মাসের দ্বিতীয় মঙ্গলবারে। ১৮৪৫ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন হয়ে থাকে এই নির্দিষ্ট দিনে। সুতরাং কোনো দৈব দুর্ঘটনা না ঘটলে এখনই বলে দেয়া যাবে আগামী বছরগুলোতে কোন দিন এবং কোন তারিখ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কারা প্রার্থী হতে পারেন?

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হতে হলে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অনুযায়ী তিনটি শর্ত পূরণ করতে হবে। শর্ত তিনটি হলো
প্রার্থীকে জন্মসূত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হতে হবে
বয়স হতে হবে অন্তত ৩৫ বছর এবং
অন্তত ১৪ বছর যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করতে হবে।
তবে মার্কিন সেনাবাহিনীর সদস্যদের জন্য শেষ শর্তটির ব্যতিক্রম রয়েছে। এছাড়াও একজন পরপর দুই টার্মের বেশি প্রার্থী হতে পারেন না।

মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কারা ভোট দিতে পারবে?

নির্বাচনে যারা ভোট দিতে পারবে তাদের অবশই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হতে হবে এবং তাদের বয়স ১৮ বছর বা তার বেশি হতে হবে। তবে অনেক রাজ্যেই আইন করা হয়েছে যে শুধু উপযুক্ত হলেই হবে না, ভোট দেবার আগে তাদের পরিচয়পত্র দেখাতে হবে।

মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয় কিভাবে?

বর্তমান বিশ্বের যেসব দেশে সাংবিধানিক গণতন্ত্রের চর্চা রয়েছে তার মধ্যে সর্বাধিক শক্তিশালী ও মর্যাদাপূর্ণ হলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। মার্কিন রাষ্ট্রপতি কেবলমাত্র একজন ব্যাক্তি নন। বর্তমান বিশ্বে নানান দিকের সমস্যাগুলোতে তাঁকে ব্যক্তিগত যোগ্যতায়ও কাজ করতে হয়। ফলে শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি কেবলমাত্র একজন সর্বোচ্চ পদাধিকারী ব্যক্তি নন। এই ক্ষেত্রে তার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ’ (Insitutionalization) ঘটেছে। তার দ্বায়িত্ব যেমন জটিল তেমনি তার নির্বাচন পদ্ধতিও।
রাষ্টপতি পরোক্ষ ভাবে নির্বাচিত হয়ে থাকেন। মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন দুটি প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়ে
প্রথমত : ‘নির্বাচক সংস্থা’ গঠন
দ্বিতীয়ত : রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়া।
নিচে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিভিন্ন ধাপসমূহ পর্যায়ক্রমে আলোচনা করা হলো:

প্রাথমিক নির্বাচন ও ককাস (Primaries and Caucuses)

নির্বাচনে লড়াইয়ের ময়দান উন্মুক্ত থাকলেও প্রাইমারি ও ককাসের মাধ্যমে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীর সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়। অর্থাৎ প্রাথমিক নির্বাচন ও ককাস হল একটি প্রাথমিক ধাপ যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের রাষ্ট্রপতি প্রার্থী নির্বাচন করে। অঙ্গরাজ্য ও দলভেদে প্রাইমারি ও ককাসের ভিন্নতা থাকলেও মূল লক্ষ্য একই। প্রার্থীর সমর্থন নির্ধারণ ও সাধারণ নির্বাচনের জন্য একজন প্রার্থী বাছাই করা। সাধারণত এই নির্বাচন ও ককাস জানুয়ারি থেকে জুন মাসের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।

প্রাথমিক নির্বাচন (Primaries): প্রাইমারিতে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে দলের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে নিবন্ধিত ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থীর জন্য সরাসরি ভোট দেন। এটি আবার দুটি প্রকার হতে পারে:

  • ওপেন প্রাইমারি (Open Primary): যেখানে যে কোনো নিবন্ধিত ভোটার কোনো একটি দলের প্রাথমিক নির্বাচনে ভোট দিতে পারেন।
  • ক্লোজড প্রাইমারি (Closed Primary): যেখানে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট দলের নিবন্ধিত ভোটাররা ভোট দিতে পারেন।


ককাস (Caucuses): ককাস হল একটি স্থানীয় সম্মেলনের মত প্রক্রিয়া যেখানে দলীয় সমর্থকরা মিলিত হয়ে আলোচনা করেন এবং তাদের পছন্দের প্রার্থীকে সমর্থন দেন। এটি একটি সময় সাপেক্ষ প্রক্রিয়া হলেও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হয়।

জাতীয় সম্মেলন (National Conventions)

প্রাথমিক নির্বাচন ও ককাস শেষ হওয়ার পর প্রতিটি রাজনৈতিক দল একটি জাতীয় সম্মেলন আয়োজন করে। প্রতিটি রাজ্যে নির্বাচিত ডেলিগেটরা মনোনীত দলীয় প্রার্থী এই অনুষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে। কনভেনশনে যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি রাজ্য থেকে আসা ডেলিগেটরা (প্রতিনিধি) প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বাছাইয়ে ভোট দেন। একজন প্রার্থীকে মনোনয়ন পেতে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পেতে হয়। যা সাধারণত গ্রীষ্মকালে হয়ে থাকে। তবে এই সম্মেলনে: একই সাথে ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থীও নির্বাচন করা হয় এবং দলীয় নীতিমালা ও ম্যানিফেস্টো গৃহীত হয়।

প্রচারণা (Campaigning)

প্রার্থীরা মনোনীত হওয়ার পর সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত প্রচারণা চালান। তারা বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ, জনসভা, বিতর্ক, বিজ্ঞাপণ ও মিডিয়ার মাধ্যমে ভোটারদের সমর্থন লাভের চেষ্টা করে থাকে। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের প্রচারণা চালায় বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিটোরিয়ামে অথবা টাউন হলে গণজমায়েত- বক্তৃতা, বিবৃতি, প্রশ্নোত্তর ইত্যাদির মাধ্যমে। তবে ক্যাম্পেইনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা দিক হলো নির্বাচনের আগে দলগুলোর প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীদের মধ্যকার ডিবেট। যা প্রেসিডেনশিয়াল ডিবেট (Presidential Debate) নামে পরিচিত। প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের মধ্যে পরপর তিনটি ডিবেট এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীদের মাঝে হয় একটি। সাধারণত এসব ডিবেট ও তাদের ফলাফলকে ঘিরে ভোটারদের মধ্যে দেখা যায় দারুণ উত্তাপ ও উত্তেজনা। বিশেষ করে আনডিসাইডেড ভোটারদের শেষ মুহূর্তে নিজেদের সিদ্ধান্ত নিতে এসব ডিবেট বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাজ্যগুলোকে তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়। যথা:-

  • রেড স্টেট -যেসকল রাজ্যে ১৯৮০ সালের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে রিপাবলিকানরা জয়ী হয়ে আসছে।
  • ব্লু স্টেট– যেসকল রাজ্যে ১৯৯২ সালের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে ডেমোক্রেটরা জয়ী হয়ে আসছে।
  • টসআপ বা সুইং স্টেট– যেসকল রাজ্যে রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটদের মধ্যে তুমুল ফাইট করে জয় পেতে হয়।

যেহেতু রেড স্টেট ও ব্লু স্টেটে যথাক্রমে রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটরা ধারাবাহিকভাবে জয়ী হয়ে আসছে, সেহেতু এসকল অঙ্গরাজ্যগুলোতে বলতে গেলে ক্যাম্পেইন হয়ই না। কারণ এতে কোনো লাভ নেই, এরা ঐতিহাসিকভাবে নিজ নিজ দলের বাঁধা ভোট। তাই সুইং স্টেটগুলোতে দলগুলোর প্রচারণা চলে তুমুলভাবে। এই সুইং স্টেটের মধ্যে বড় হলো তিনটি- পেনসিলভানিয়া, ওহাইও ও ফ্লোরিডা। বলা হয়ে থাকে এই ৩টি স্টেটের মধ্যে যেকোনো ২টি স্টেট যে দল পেয়ে থাকে তিনিই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে থাকে।

সাধারণ নির্বাচন (General Election)

নভেম্বরের প্রথম সোমবারের পরের মঙ্গলবার সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে ভোটাররা তাদের পছন্দের ইলেক্টরকে ভোট দেন। সেখানে ব্যালট পেপারে প্রার্থীদের নাম থাকে এবং ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থীর নামের পাশে চিহ্ন দিয়ে ভোট দেন।

ইলেক্টোরাল কলেজ (Electoral College)

সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট নয়, বরং মার্কিন প্রেসিডেন্ট কে হবেন, তা নির্ধারণ করে ইলেকটোরাল কলেজ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সাধারণ জনগণ কতৃক নির্বাচিত ইলেক্টররা ইলেক্টোরাল কলেজের গিয়ে রাষ্ট্রপতি ও ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫০ টি অঙ্গরাজ্য এবং ওয়াশিংটন ডিসি এই নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় আইনসভা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেট সদস্যগণ ইলেক্টোরাল ভোটে অংশগ্রহণ করে। জনসংখ্যার অনুপাতে ৫০ টি অঙ্গরাজ্য থেকে মোট ৪৩৫ জন সদস্য ‘হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভস’ (কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদ) নির্বাচিত হয় জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে। এ সকল প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হয় প্রতি দুই বছর পর পর। অপর দিকে প্রতি ছয় বছর পর পর পর্যায়ক্রমে রোটেশনের মাধ্যমে ছোট-বড় প্রতিটি অঙ্গরাজ্য থেকে ২ জন করে মোট ১০০ জন সদস্য সিনেটে নির্বাচিত হয়ে আসেন। এছাড়াও ওয়াশিংটন ডিসির (ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়া) রয়েছে ৩ জন ইলেকটর। সব মিলিয়ে ৫৩৮টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট। অর্থাৎ ইলেক্টোরাল কলেজে মোট ৫৩৮টি ইলেক্টর রয়েছে এবং একজন প্রার্থীকে নির্বাচিত হতে হলে কমপক্ষে ২৭০টি ইলেক্টোরাল ভোট পেতে হয়।

ইলেক্টর নির্বাচন: প্রতিটি রাজ্য তাদের কংগ্রেস সদস্যসংখ্যার সমান সংখ্যক ইলেক্টর নির্বাচন করে। তবে বেশিরভাগ রাজ্যে “Winner-takes-all” পদ্ধতি প্রযোজ্য।
ইলেক্টোরাল ভোট: ডিসেম্বরের দ্বিতীয় বুধবারের পরে প্রথম সোমবারে ইলেক্টররা তাদের ভোট দেন। ইলেক্টররা তাদের নিজ নিজ রাজ্যের রাজধানীতে মিলিত হন এবং ভোট দেন।

কংগ্রেসে ভোটের গণনা (Counting Votes in Congress)
জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে ইলেক্টোরাল ভোটগুলো গণনা করা হয়। কংগ্রেসের সভাপতি ইলেক্টোরাল ভোটের ফলাফল আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন। এই সময় যদি কোনো প্রার্থী ২৭০টি ইলেক্টোরাল ভোট পান, তবে তাকে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা হয়।

অভিষেক (Inauguration)
নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ও ভাইস প্রেসিডেন্টের কার্যকাল ২০ জানুয়ারি শুরু হয়। এই দিনে একটি অভিষেক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় যেখানে তারা শপথ নেন এবং তাদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

Leave a Comment