নিচের যে অংশটি সম্পর্কে জানতে চান, ক্লিক করুন
- ভিটামিন ডি (Vitamin D) কি?
- আমাদের শরীরে ভিটামিন ডি এর কাজ কি?
- ভিটামিন ডি এর প্রকারভেদ
- ভিটামিন ডি২ বা Vitamin D2 (Ergocalciferol) কি?
- ভিটামিন ডি৩ বা Vitamin D3 (Cholecalciferol) কি?
- শরীরে ভিটামিন ডি ঘাটতির লক্ষণসমূহ কি কি?
- মানবদেহে ভিটামিন ডি এর আদর্শ পরিমান কত?
- ভিটামিন ডি এর দৈনিক চাহিদা কেমন?
- মানবদেহে ভিটামিন ‘ডি’ ঘাটতির কারণ কি?
- ভিটামিন ডি এর প্রধান উৎস কি?
- ভিটামিন ডি যুক্ত খাবার কি কি?
- ভিটামিন ডি কাদের বেশি প্রয়োজন?
- অতিরিক্ত ভিটামিন ডি সেবনের ক্ষতিকর দিক
ভিটামিন ডি (Vitamin D) কি?
ভিটামিন ডি হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাট-সোলিউবল (চর্বিতে দ্রবণীয়) ভিটামিন, যা ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও ফসফেট এর আন্ত্রিক শোষণ এবং মানবদেহে বিভিন্ন জৈবিক প্রভাব সৃষ্টির জন্য দায়ী। সরাসরি সূর্যের আলোতে আমাদের শরীর প্রাকৃতিকভাবে ভিটামিন ডি উৎপন্ন করে। তবে কিছু নির্দিষ্ট খাবার ও সাপ্লিমেন্ট থেকেও ভিটামিন ডি পাওয়া যায়।
আমাদের শরীরে ভিটামিন ডি এর কাজ কি?
স্বাস্থ্যকর ও সুস্থ থাকার জন্য ভিটামিন ডি এর প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। ভিটামিন ডি এর অভাব, সারা জীবন ধরে মানুষকে প্রভাবিত করে। মানব শরীরে ভিটামিন ডি মজবুত হাড়, মাংসপেশী এবং স্নায়ুতন্ত্রের কার্যক্রমের পরোক্ষভাবে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। এ ছাড়া নির্দিষ্ট কিছু রোগের প্রতিরোধ ক্ষমতাও তৈরি করতে পারে। ফলে অন্যদিকে যদি ভিটামিন ডি এর ঘাটতি দেখা দেয় তাহলে শরীরের হাড় ভঙ্গুর এবং পেশী দুর্বল হয়ে পড়ে। এগুলোর পাশাপাশি ভিটামিন ডি দেহের ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে।
ভিটামিন ডি এর প্রকারভেদ
ভিটামিন ডি কে সাধারণত দুই ভাবে ভাগ করা যায়। যথা:-
১) ভিটামিন ডি২ (Ergocalciferol)
২) ভিটামিন ডি৩ (Cholecalciferol)
ভিটামিন ডি২ বা Vitamin D2 (Ergocalciferol) কি?
ভিটামিন ডি২ বা ভিটামিন D2 সাধারণত উদ্ভিদ এবং ছত্রাক থেকে বেশি পাওয়া যায়। এর রাসায়নিক গঠন সম্পর্কে বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় ভিটামিন ডি২ সর্বপ্রথম রাসায়নিকভাবে সংশ্লেষিত করা হয়েছিল ১৯৩১ সালে।
আর্গোস্টেরলের (Ergosterol) অতিবেগুনি রশ্মির বিকিরণ থেকে ভিটামিন ডি২ এর রাসায়নিক গঠন সংজ্ঞায়িত করা হয়। ভিটামিন ডি২ তে কার্বন ২৪ এর উপর একটি মিথাইল গ্রুপ রয়েছে।
ভিটামিন ডি৩ বা Vitamin D3 (Cholecalciferol) কি?
ভিটামিন ডি২ বা ভিটামিন D2 সাধারণত প্রাণীজ উৎস ও সূর্যের আলো থেকে পাওয়া যায়। সর্বপ্রথম ১৯৩৫সালে এর রাসায়নিক গঠন সংজ্ঞায়িত করা হয়।
7-ডিহাইড্রোকোলেস্টেরলের অতিবেগুনি রশ্মির বিকিরণ থেকে ভিটামিন ডি3 এর রাসায়নিক গঠন সংজ্ঞায়িত করা হয়।
শরীরে ভিটামিন ডি ঘাটতির লক্ষণসমূহ কি কি?
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষ ভিটামিন ডি এর ঘাটতির উপসর্গগুলো নির্ণয় করতে পারেনা । কারণ এসব উপসর্গ আমাদের দৈনন্দিন কাজ কর্মের সাথে মিশে যায়। ফলে অনেকগুলো লক্ষণ একত্রে দেখ না দিলে সহজে ভিটামিন ডি এর ঘাটতি নির্ণয় করা যায়না।
নিচে এর সাধারণ লক্ষণগুলো দেয়া হলো –
- চলাফেরার সময় পেশী ব্যাথা
- হাত বা পায়ের হাড় ব্যাথা
- ব্যাথার তীব্রতা বা সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি পাওয়া
- খুব ঘাটতিতে পেশীর খিচুঁনি হওয়া
- অল্প কাজে পেশী বা হাড়ে কাঁপুনি উঠা
- থাইরয়েডে সমস্যা সাথে মেরুদণ্ডের ব্যথা ও অসময়ে দাঁত পড়ে যাওয়া
- অকারণে ক্লান্তিভাব ও ঝিমুনি
- পায়ের হাড় অকারণে বেঁকে যাওয়া, এটি শিশুদের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায়।
মানবদেহে ভিটামিন ডি এর আদর্শ পরিমান কত?
মানবদেহে ভিটামিন ডি ঘাটতি আছে কীনা তা নির্ভর করে রক্তে থাকা ভিটামিন ডি এর উপরে। যদি রক্তে থাকা ভিটামিন শরীরের পেশীর স্বাস্থ্য বজায় রাখতে যথেষ্ট না হয় তখন তাকে ভিটামিন ডি এর ঘাটতি বলে বিবেচনা করা হয়। তবে ইনস্টিটিউট অফ মেডিসিনের সিদ্ধান্ত মতে মানবদেহে 25-হাইড্রোক্সিভিটামিন ডি এর 20-50 ng/mL মাত্রায় ভিটিামিন ডি প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্রের কিছু গবেষকের মতে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য নূন্যতম 30 ng/ml মাত্রায় ভিটামিন ডি প্রয়োজন। শিশু থেকে বৃদ্ধ প্রত্যাকের শরীরে ভিটামিন ডি তার বয়স অনুযায়ী পর্যাপ্ত পরিমানে থাকা প্রয়োজন। অন্যথায় শিশুর শরীরের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হওয়া থেকে বৃদ্ধের শারীরিক কার্যক্ষমতা হারাতে পারে। কোন শিশুর মায়ের শরীরে যদি ভিটামিন ডি এর ঘাটতি থাকে তাহলে সে শিশু বুকের দুধ থেকে পর্যাপ্ত পরিমানে ভিটামিন ডি পায়না। এক্ষেত্রে পরিস্থিতি বিবেচনায় পরিপূরক গ্রহণ করা লাগতে পারে।
ভিটামিন ডি এর দৈনিক চাহিদা কেমন?
ভিটামিন ডি-এর দৈনিক চাহিদা বয়স ভেদে আলাদা আলাদা। নিচে বয়স ভেদে ভিটামিন ডি-এর দৈনিক চাহিদা দেয়া হলো:
বয়স শ্রেণি | ভিটামিন ডি-এর দৈনিক চাহিদা[ 1 μg = 40 IU ] |
শিশু, কিশোর এবং 50 বছরপর্যন্ত ব্যাক্তিদের জন্য | 200 IU বা 5 μg |
51 থেকে 70 বছর পর্যন্তব্যাক্তিদের জন্য | 400 IU বা 10 μg |
70 বছরের বেশিব্যাক্তিদের জন্য | 600 IU বা 15 μg |
মানবদেহে ভিটামিন ‘ডি’ ঘাটতির কারণ কি?
নানান কারণে শরীরে ভিটামিন ‘ডি’ এর ঘাটতি দেখা দিতে পারে। তবে গুলোর মধ্যে প্রাথমিক দুটি কারণ হলো খাবার ও শরীরে পর্যাপ্ত সূর্যের আলোর অভাব। এই দুইটি কারণ খুব সহজেই এবং দ্রুত সমাধান করা যায়। তবে এর বাইরেও কিছু কারণ রয়েছে যা প্রাথমিকভাবে নির্ধারণ ও সমাধান করা কঠিন। নিচে এমনই কিছু কারণ দেয়া হলো –
১. কিডনি ও লিভারের অকেজো হয়ে পড়া।
২. ঔষধের পার্শপ্রতিক্রিয়া।
৩. লিম্ফোমা বা এই জাতীয় ক্যান্সার।
৪. পূর্বে পরিবার রিকেটে আক্রান্ত হওয়া ইত্যাদি।
উল্লেখ্য কারণ সমূহ সহজে চিহ্নিত করা কঠিন। তাই খাবার ও পর্যাপ্ত সূর্যের আলোর মধ্যে থাকার পরেও প্রথমে উল্লেখকৃত লক্ষণ সমূহ থাকলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।
ভিটামিন ডি এর প্রধান উৎস কি?
পূর্ণবয়ষ্ক মানুষের ক্ষেত্রে সূর্যের আলো ও খাবারই হলো ভিটামিন ডি এর প্রধান উৎস। সূর্যের আলোয় মানুষের ত্বক অতিবেগুনি রশ্মিকে ভেঙে ভিটামিন ডি তে রুপান্তরিত করে। এক্ষেত্রে একজন পূর্ণবয়ষ্ক মানুষ প্রতি দুই দিনে একবার ১০-১৫ মিনিট সূর্যের আলোয় নিজের শরীরে যতটুকু সম্ভব উন্মুক্ত রাখলে প্রয়োজনীয় ভিটামিন ডি তৈরি হতে পারে। এর জন্য সকাল ১০ টা থেকে বেলা ৩ টা পর্যন্ত উপযুক্ত সময়।
ভিটামিন ডি যুক্ত খাবার (Vitamin D Foods) কি কি?
নিচে ভিটামিন ডি যুক্ত খাবারের তালিকা বর্ণনা করা হলো:
১) মাছ :- মাছ বরাবরই ভিটামিন ডি এর জন্য আদর্শ উৎস। এর মধ্যে বাংলাদেশের জনপ্রিয় মাছগুলো মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো – ইলিশ, রুই, চাঁন্দা, কাতলা ও পাঙ্গাস। আর সামুদ্রিক মাছের ক্ষেত্রে, সালমন (Salmon), ম্যাকারেল (Mackerel), টুনা (Tuna) আর ট্রাউট (Trout) উল্লেখযোগ্য।
২) ডিম :- ডিমের মধ্যে দেশী মুরগীর ডিমের কুসুম ভিটামিন ‘ডি’ এর জন্য পরিচিত। পাশাপাশি হাঁসের ডিম ও খাওয়া যায়। তবে এটি হাইপ্রেশার রুগীদের জন্য উপযোগী নয়।
৩) গরুর কলিজা :- সুস্বাদু, পুষ্টিকর ও প্রচুর ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবারের মধ্যে গরুর কলিজা অন্যতম।
৪) দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার :- বাংলাদেশে সহজলভ্য গরুর দুধ, ঘি এবং দুধ থেকে তৈরি দই ভিটামিন ডি এর একটি বড় উৎস।
৫) ফর্টিফায়েড খাবার ও মাশরুম :- বিভিন্ন ব্র্যান্ডের দুগ্ধজাত পণ্য, সয়াবিন তেল এবং ভিটামিন ডি যোগ করা সিলড খাবার পাওয়া যায়। এর পাশাপাশি সূর্যের আলোতে হওয়া মাশরুমও ভিটামিন ডি এর চাহিদা পূরণ করে থাকে।
খাবারের পাশাপাশি খুব সহজেই আমাদের শরীরে সূর্যের আলোর মাধ্যমে ভিটামিন ডি উৎপন্ন হয়। তবে তারপরও যদি শরীরে ভিটামিন ডি এর অভাব রয়েছে তারা সাপ্লিমেন্ট অথবা ট্যাবলেট ব্যবহার করতে পারেন।
ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট (Vitamin d supplement) ও এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া:
দেশের বাজারে বেশ কয়েকটি কোম্পানির ভিটামিন ডি এর সাপ্লিমেন্ট পাওয়া যায়। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী আপনার জন্য প্রয়োজনীয় মাত্রার সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে পারেন। তবে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট ব্যবহার করা নিরাপদ নয়। সাপ্লিমেন্ট ব্যবহারে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যেতে পারে। যেমন মাথা ব্যাথা, বমি বমি ভাব,কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদি।
ভিটামিন ডি ট্যাবলেটস (Vitamin d tablets) ও এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া:
ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করে ভিটামিন ডি ট্যাবলেটস গ্রহণ করতে পারেন। তবে এ ক্ষেত্রেও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ভিটামিন ডি খাওয়া মারাত্মক ক্ষতি ।
ভিটামিন ডি কাদের বেশি প্রয়োজন?
সবারই ভিটামিন ডি দেহে পযাপ্ত পরিমানে থাকা প্রয়োজন। তবে শিশু, বৃদ্ধ, গর্ভবতী বা স্তন্যদানকারী মা ও শারীরিকভাবে সংক্রিয় ব্যাক্তির ভিটামিন ডি দৈনিক পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকাটা অতি প্রয়োজন। অন্যথায় শিশুদের ক্ষেত্রে রিকেটস, প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে অস্টিওম্যালাসিয়া ও নারীদের মানসিক স্বাস্থ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
অতিরিক্ত ভিটামিন ডি সেবনের ক্ষতিকর দিক
দীর্ঘসময় ধরে মাত্রাতিরিক্ত ভিটামিন ডি সেবনে হাইপারক্যালসেমিয়া নামক এক ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয়। এছাড়াও শরীরের নানান ক্ষতি যেমন : কিডনিতে পাথর, বমি ও বমি ভাব ও হৃদযন্ত্রের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। নিচে হাইপারক্যালসেমিয়ার সাধারণ লক্ষণ দেয়া হলো :
১. পাচনতন্ত্রের সমস্যা – ক্ষুধামন্দা, পেটে ব্যথা।
২. মাংসপেশীর সমস্যা – পেশীর ব্যথা এবং খিঁচুনি।
৩. স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা – বিভ্রান্তি বা স্মৃতিভ্রংশ ও অবসন্নতা।
৪. হৃদযন্ত্রের সমস্যা – অনিয়মিত হার্টবিট ও হৃদপিণ্ডের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হ্রাস।
৫. মাথাব্যথা এবং অবসাদ।